ব্রেন টিউমার: লক্ষণ, সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা
ব্রেন টিউমার হলো মস্তিষ্কের কোষগুলির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে। ব্রেন টিউমার দুই ধরনের হতে পারে:
প্রাইমারি টিউমার: যা মস্তিষ্ক থেকেই শুরু হয়।
সেকেন্ডারি টিউমার: যা শরীরের অন্য অংশ থেকে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রেন টিউমার সনাক্ত করা অনেক সময় কঠিন হতে পারে কারণ এর লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং অনেক সময় সাধারণ সমস্যার মতো দেখা দেয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে যা ব্রেন টিউমারের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে।
নিয়মিত এবং তীব্র মাথাব্যথা
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রেন টিউমারের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো তীব্র মাথাব্যথা। এই ব্যথা সাধারণত সকালে বেশি হয় এবং সময়ের সাথে সাথে তীব্র হতে থাকে। ব্যথার সঙ্গে বমি বা বমি বমি ভাবও থাকতে পারে। যদি আপনি আগে কখনো এ ধরনের তীব্র মাথাব্যথা অনুভব না করে থাকেন এবং হঠাৎ করে এমন সমস্যা শুরু হয়, তবে এটি একটি সতর্কতা সংকেত হতে পারে।
চোখের সমস্যা
ব্রেন টিউমার মস্তিষ্কের অংশে চাপ সৃষ্টি করে যা চোখের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে চোখে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন:
ডাবল ভিশন: এক জিনিস দু’বার দেখা।
ঝাপসা দেখা: দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।
চোখের মুভমেন্টে সমস্যা: চোখের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণে সমস্যা।
বমি বমি ভাব ও বমি
নিয়মিত বমি বমি ভাব বা বমি, বিশেষ করে মাথাব্যথার সঙ্গে হলে, এটি ব্রেন টিউমারের লক্ষণ হতে পারে। বিশেষত সকালে বমি হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
স্মৃতিভ্রংশ ও মানসিক পরিবর্তন
ব্রেন টিউমার মস্তিষ্কের কার্যক্রমে পরিবর্তন এনে স্মৃতিভ্রংশ, মনোযোগ কমে যাওয়া, বা মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। এটি মেজাজ পরিবর্তন বা ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হিসেবেও দেখা যেতে পারে। যেমন:
অতিরিক্ত রাগ বা মেজাজের পরিবর্তন।
মনোযোগের অভাব বা বিভ্রান্তি।
স্মৃতিভ্রংশ বা নতুন তথ্য মনে রাখতে সমস্যা।
দুর্বলতা ও অসাড়তা
শরীরের কোনো একপাশে দুর্বলতা, অসাড়তা বা প্যারালাইসিস ব্রেন টিউমারের লক্ষণ হতে পারে। এটি সাধারণত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে চাপ সৃষ্টি করে। যদি হঠাৎ করে আপনার শরীরের কোনো অংশ দুর্বল বা অসাড় হয়ে যায় তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অবসাদ ও ক্লান্তি
ব্রেন টিউমারের কারণে শরীরে অবসাদ এবং অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব হতে পারে। নিয়মিত কাজ করতে গেলে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া বা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে অসুবিধা হওয়া এর লক্ষণ।
কথা বলতে অসুবিধা
ব্রেন টিউমার মস্তিষ্কের ভাষা কেন্দ্রকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে। যেমন:
কথা বলার সময় শব্দ ভুল হওয়া।
কথার গতি কমে যাওয়া।
একটি নির্দিষ্ট শব্দ বা বাক্য বলতে সমস্যা।
খিঁচুনি (Seizures)
খিঁচুনি বা আকস্মিক আক্রমণ ব্রেন টিউমারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। যদি আগে কখনো খিঁচুনি না হয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে খিঁচুনি শুরু হয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। খিঁচুনির লক্ষণগুলির মধ্যে থাকতে পারে:
শরীরের আকস্মিক ও অস্বাভাবিক মুভমেন্ট।
চোখের পাতা ফড়ফড় করা।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
ব্রেন টিউমার সনাক্তকরণ
ব্রেন টিউমার সনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা এবং প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।
শারীরিক পরীক্ষা
প্রাথমিকভাবে, চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং লক্ষণগুলি মূল্যায়ন করবেন। এটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে:
নার্ভের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা।
চোখের পরীক্ষার মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তির মূল্যায়ন।
শারীরিক প্রতিক্রিয়া এবং মুভমেন্ট পরীক্ষা।
ইমেজিং পরীক্ষা
ব্রেন টিউমার সনাক্ত করার জন্য ইমেজিং পরীক্ষা অত্যন্ত কার্যকর। কিছু সাধারণ ইমেজিং পরীক্ষা হলো:
MRI (Magnetic Resonance Imaging): মস্তিষ্কের বিস্তারিত ছবি প্রদান করে।
CT স্ক্যান (Computed Tomography): মস্তিষ্কের ক্রস-সেকশনাল ছবি প্রদান করে।
PET স্ক্যান (Positron Emission Tomography): মস্তিষ্কের কার্যক্রম মূল্যায়ন করে।
বায়োপসি
ব্রেন টিউমারের প্রকৃতি সনাক্ত করার জন্য বায়োপসি করা হয়। এটি একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের টিউমার থেকে একটি ছোট অংশ নিয়ে পরীক্ষাগারে বিশ্লেষণ করা হয়।
ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা
ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা নির্ভর করে টিউমারের আকার, অবস্থান, এবং প্রকারের উপর। সাধারণত নিম্নলিখিত চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়:
সার্জারি
সার্জারি বা অপারেশনের মাধ্যমে টিউমার সরিয়ে ফেলা হয়। সার্জারির মাধ্যমে টিউমারের সম্পূর্ণ বা আংশিক অপসারণ করা হয়। সার্জারি চিকিৎসার সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি।
রেডিওথেরাপি
রেডিওথেরাপি একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে উচ্চ-শক্তির রেডিয়েশন ব্যবহার করে টিউমার কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি সাধারণত সার্জারির পরে বা সার্জারির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপি একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ওষুধ ব্যবহার করে টিউমার কোষ ধ্বংস করা হয়। এটি সাধারণত রেডিওথেরাপির সাথে সংযুক্ত করে ব্যবহার করা হয়।
ইমিউনোথেরাপি
ইমিউনোথেরাপি একটি আধুনিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে টিউমার কোষ ধ্বংস করতে সক্রিয় করা হয়।
উপসংহার
ব্রেন টিউমার একটি গুরুতর রোগ যা দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রাথমিক লক্ষণগুলি চিনতে পারা এবং দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া আপনার সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা দেরি করলে জটিলতা বাড়তে পারে এবং রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই, যদি আপনি উপরের কোনো লক্ষণ দেখতে পান তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আপনার মুল্যবান বক্তব্য লিখুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url